সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সা.)


হজরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ। তিনি মানবজাতির জন্য এক মহান কল্যাণ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসুল (সা.) সম্পর্কে বলেন, '(হে রাসুল!) আমি আপনাকে সারা জাহানের রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি।' (২১:১০৭) মহানবীকে (সা.) সর্বাধিক মানবিক গুণ ও সর্বোত্তম চরিত্রবিশিষ্ট করে মানবজাতির সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে এ জন্য যে যাতে মানবতার জন্য অনন্য আদর্শ হিসেবে চিরকাল তিনি মানুষকে সত্য, সুন্দর ও মুক্তির পথে আহ্বান জানাতে পারেন। তিনি তাঁর নবুয়তি জীবনে একদিকে যেমন মানুষের আত্মিক উন্নতি তথা আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্কোন্নয়ন, অন্যদিকে এই পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হবে তারও শিক্ষা প্রদান করেছেন। তাঁর এই শিক্ষা যত দিন পর্যন্ত মানুষ যথাযথভাবে পালন করেছে, তত দিন দুনিয়ার বুকে শান্তি বিরাজ করেছে। আর যখনই মানুষ তার শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছে, তখনই দেখা দিয়েছে নানা সংকট ও সমস্যা। আধুনিক সমাজব্যবস্থায় যে সমস্যা বেশি লক্ষণীয় তা হচ্ছে মানুষে মানুষে সম্পর্ক। এ সম্পর্কের ক্ষেত্রে আজ গোত্র-রক্ত-বর্ণ-ধর্ম-ভাষা নানা প্রভাব ফেলছে অথচ প্রকৃত সত্য হচ্ছে সব ভাষা, গোত্র, বর্ণ ও ধর্মের মানুষ একই বংশজাত, তথা একই পিতা আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.)-এর সন্তান। পবিত্র কোরআনে এরই সমর্থনে দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা এসেছে_'হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো।' (৪৯:১৩)
রাসুল (সা.) আল্লাহপ্রদত্ত এ মূলনীতিকে উপজীব্য করে মানুষে মানুষে সাম্য-শৃঙ্খলা-ঐক্যের সমন্বয় সাধন করে সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল ও অনুপম নিদর্শন রেখে গেছেন। হিজরতের পর মদিনায় প্রতিষ্ঠিত নগর রাষ্ট্রের জন্য ঘোষিত মদিনা সনদে তিনি এ নীতির সফল বাস্তবায়নও করেন। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত শাসনতন্ত্র। এর প্রথম শর্তেই ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে একটি জাতিসত্তার কথা বলা হয়। যা জাতীয় ঐক্য ও সংহতি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের ঔজ্জ্বল্যে বিভাসিত হয়। মদিনা সনদে ঘোষণা এসেছে_'মদিনায় ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ও মুসলিম সবাই এক দেশবাসী, সবার নাগরিক অধিকার সমান, সবাই নির্বিঘ্নে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করবে না।' মানব ইতিহাসে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ উদাহরণ এক বিরল ঘটনা। দুনিয়ার সব মানুষ একই আদমের সন্তান হিসেবে একে অপরের ভাই। তাই একজন আরেকজনের ওপর প্রভুত্ব করবে, একজন আরেকজনকে জুলুমের জাঁতাকলে নিষ্পেষণ নির্যাতন করবে_এটা তো মানবতাবিরোধী। আর বিশ্বনবীর এই পৃথিবীতে আগমনের উদ্দেশ্যে মূলত জুলুম-অত্যাচার দূরীভূত করে প্রকৃত ভ্রাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, 'অবশ্যই মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমার ভাইয়ের মধ্যে শান্তি স্থাপন করো, যাতে তোমরা রহমত পেতে পারো।' (সুরা হুজরাত-১০) রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সব মুসলিম একে অন্যের ভাই। তিনি ঐতিহাসিক বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছেন, 'তোমরা সবাই আদম সন্তান। আর আদম মাটির তৈরি। একমাত্র তাকওয়া ছাড়া অনারবদের ওপর আরবদের আর আরবদের ওপর অনারবদের কোনো প্রাধান্য নেই' (বায়হাকী)। মহানবীর এই আদর্শে গোত্রভিত্তিক সমাজের কৃত্রিম আভিজাত্য বোধের মূলে কুঠারাঘাত করে এবং সংকীর্ণ সে সমাজ নির্মূল হয়ে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হয়ে উদার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিভিত্তিক সমাজের উদ্ভব ঘটে। এ সম্পর্কে খুদা বক্স বলেন, The Immediate result of the prophet's teaching was the dissolution of the tribal system and the foundation of brotherhood of Islam. নবী (সা.)-এর শিক্ষার প্রত্যক্ষ ফল হলো গোত্রভিত্তিক সমাজের আধিপত্য বিলোপ সাধন করে ইসলামী ভ্রাতৃত্বে অনুপ্রাণিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। তিনি কেবল আরববাসীদের মধ্যে কিংবা শুধু মুসলিম উম্মাহর মধ্যেই নয়, বরং জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সব মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি, শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে দুনিয়ায় এক অক্ষয় আদর্শের প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তাঁর আদর্শের মূল ভিত্তি হলো ধর্ম, জাতি, দেশ ভিন্ন হলেও সব মানুষ মূলত একই পরিবারভুক্ত। মুসলিম, অমুসলিম সব বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন_অমুসলিমের জান ও মাল এবং আমাদের জান ও মাল এক ও অভিন্ন। তিনি আরো বলেন_যে মুসলিম অমুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সামান্য জুলুম করবে তার বিরুদ্ধে আমি কেয়ামতের দিন আল্লাহর দরবারে অভিযোগ আনব। মূলত মহানবী (সা.)-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-ইহুদি-পারসিক এবং আরবি-অনারবি, আফগানি-ইরানি-তুর্কি-কাফ্রি-সাদা-কালো-চীনা ইউরোপীয় বিশ্বের সব দেশ ও জাতির লোককে একত্র করে একই মিলন সূত্রে আবদ্ধ করে মহাশান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পেয়েছে। তাই একজন খ্রিস্টান ধর্মানুসারীর কথায় তার প্রতিফলন লক্ষণীয়। যেমন মাইকেল হার্ট তাঁর 'দ্য হানড্রেড' গ্রন্থে দ্বিধাহীনচিত্তে উল্লেখ করেছেন_He (Muhammad) was the only man in history who was supremely on both the religious and secular level...- It is this unparalleled combination of secular and religious influence which I feel entitles Muhammad to be considered the most influential single figure in history. রক্ত ও বর্ণের পার্থক্যের জন্য যুগে যুগে দেশে দেশে বহু দ্বন্দ্ব-সংঘাত ঘটেছে, সংঘটিত হয়েছে বহু ভয়াবহ যুদ্ধ, নিকট অতীতেও হয়েছে এখনো হচ্ছে। যেমন_বাবরী মসজিদকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সবচেয়ে হৃদয়বিদারক সংঘাত হয়েছে ভারতের গুজরাটে। যাতে হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও শিশুর রক্তের স্রোতে মাঠ-ঘাটের চেহারা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং লাশের গন্ধে আকাশ-বাতাস হয়েছিল ভারী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের জিনজিয়া প্রদেশ, মিসর, ইন্দোনেশিয়া ও কিরগিজিস্তানেও সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত দাঙ্গায় অনেক তাজা প্রাণের মূল্য দিতে হয়েছে। কিন্তু মহানবী (সা.) ইসলামের মর্মবাণীর আলোকে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে রক্ত বর্ণের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে যে সাম্প্রদায়িকতা, তার মূলোচ্ছেদ করেছেন। ইহুদিদের নবী হজরত মুসাকে (আ.) প্রিয় নবী (সা.) যখন সত্য নবী হিসেবে ঘোষণা দেন, তাদের কিতাব তাওরাতকে যখন আল্লাহর কিতাব হিসেবে ঘোষণা দেন। অনুরূপ খ্রিস্টানদের নবী ঈসা (আ.) এবং তাদের কিতাব ইঞ্জিলকে যখন আল্লাহর নবীও বাণীরূপে ঘোষণা দেন। আরো ঘোষণা দেন সব নবী ও সব কিতাবকে সত্য বলে। তখন তাদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ, তাদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি, নবী ও কিতাবের বিভিন্নতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি ঝগড়া-বিবাদ করতেও নিষেধ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে_'আহলি কিতাবদের সঙ্গে বিতর্কে অবতীর্ণ হবে না আর হলেও তা করবে অতীব উত্তমভাবে।' (২৯:৪৬) আসলে নবী করিম (সা.) গড়ে তুলতে চেয়েছেন তাদের সঙ্গে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের সম্পর্ক, বিভিন্নতা সত্ত্বেও সত্যের স্বীকৃতি দিয়ে বৃহত্তর মানবীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে। অথচ তাদের কিতাব ও নবীদের সত্য বলে মানা সত্ত্বেও তারা বিদ্বেষবশত হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহর নবী এবং কোরআনকে আল্লাহর কিতাব বলে স্বীকৃতি দেয়নি। তারা বৃহত্তর ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলার আহ্বানকে অগ্রাহ্য করে বিশ্বনবী (সা.), কোরআন এবং মুসলিম উম্মাহকে ধ্বংস করার জন্য বারবার আঘাত হেনেছে। এতদসত্ত্বেও মহানবী (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা এবং তাঁর উম্মতরা ইতিহাসের কোনো অধ্যায়ই সাম্প্রদায়িকতার পরিচয় দেননি। পরিচয় দিয়েছেন নিজেদের উদারতার, মহত্ত্বের ও মহানুভবতার, প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি স্থাপনের। ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত অসংখ্য ও অগণিত। বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের লোককে একই সমাজে, একই রাষ্ট্রে কিভাবে মিলেমিশে বসবাস করতে হবে_এ হচ্ছে তার এক শাশ্বত দলিল। পরমতসহিষ্ণুতা, উদারতা, মহানুভবতা এবং বিভিন্নতার মধ্যেও ঐক্য হচ্ছে প্রিয় নবীর আদর্শ ও ইসলামের অনুপম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর কিতাব তাওরাত ও ইঞ্জিলে যেসব বিবৃতি সাধন করা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) তার অনেকই ইহুদি, খ্রিস্টানকে দেখিয়ে দিয়েছেন। তাদের সংশোধন হতে বলেছেন, সত্যের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। তারা সে আহ্বানে কর্ণপাত না করলেও তাদের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হননি এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। এমনি করে খায়বার বিজয়ের পরে প্রিয় নবী (সা.) বিজিত ভূমির ইহুদি অধিবাসীদের সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তাদের স্ব-স্ব ধর্ম পালনের অধিকার প্রদান করেছিলেন। এমনকি মদিনায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ইহুদিদের বাড়ি-ঘর ও ধন-সম্পত্তি আগের মতোই যার যার অধিকারে রেখে দিয়েছিলেন। প্রিয় নবী (সা.) এমন এক যুগসন্ধিক্ষণে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন, যখন হানাহানি-কাটাকাটি-খুনাখুনি মহামারি আকার ধারণ করে, কোথাও শান্তি বলতে কিছুই ছিল না, নৈরাশ্য ও নৈরাজ্যে নিপতিত ছিল মানবসভ্যতা। সেই করুণ অবস্থা থেকে মানবতাকে উদ্ধার করতে, আসসিরাতুল মুস্তাকীমে মানবসভ্যতাকে সংস্থাপন করতে, মানুষে মানুষে বিবাদ-বিসংবাদ দূর করে সত্যিকার সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে তিনি তাশরিফ আনলেন। তিনি এলেন মানব জাতিকে শান্তি ও সুখের পথে পরিচালিত করতে। আমরা আরো লক্ষ করি যে যখন মক্কার কাফির মুশরিকরা তাঁর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করছে, তখনো তিনি ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন করে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের কথা বলেছেন এবং মদিনা মনুওয়ারায় হিজরত করার পরও তারা কিছু মুনাফিক ও ইহুদিদের সঙ্গে যোগসাজশ করে বারবার মদিনা আক্রমণ করেছে। তবুও মহানবী ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে বৃহত্তর সম্প্রীতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হোদায়বিয়ার সন্ধি করেছেন। যদিও সন্ধির কিছু ধারা মুসলমানদের অনুকূলে ছিল না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশ্ববাসীর সামনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই যে নজির রেখেছেন তা যেমন বিশ্বজনীন, তেমনি কেয়ামত অবধি সর্বকাল ও সর্বসময়ের জন্য তা প্রযোজ্য। তাই বিশ্ববাসী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বকালে সর্বযুগের মহান শিক্ষক হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রদর্শিত পন্থাই একমাত্র সমাধান। যা তিনি সপ্তম শতাব্দীতে মদিনায় কল্যাণ রাষ্ট্র স্থাপনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছেন। তাই আমাদের উচিত হবে মানবতার মহান শিক্ষক মহানবী (সা.) তাঁর সমগ্র জীবনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব স্থাপনে যে নীতি অবলম্বন করেছেন, আমরাও যেন তা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান সংঘাতময় পৃথিবীতে শান্তির মশাল জ্বালাতে পারি এবং আহ্বান জানাতে পারি সম্প্রীতির, ঐক্যের ও মানব প্রেমের।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন