ধনী হতে স্বামী-স্ত্রী মিলে শুরু করে শিশু অপহরণ
ধনী হওয়ার জন্য শিশু অপহরণ করত আবদুল মতিন (মফিজ) (৫৫)। আর তাকে সহযোগিতা করেছে তারই স্ত্রী মরিয়ম বেগম। বিভিন্ন জেলায় নিজেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে বাড়ি ভাড়া নিত মতিন। ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে বাড়ির লোকদের খুব কাছে চলে যেত, অল্প সময়ে হয়ে উঠত আপনজন। পরে সুযোগ বুঝে সেই বাড়ির শিশুকে নিয়ে পালিয়ে যেত, আর দাবি করত মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ। মতিনের টার্গেট ছিল দুই বছরের কম বয়সী শিশু। কারণ এ বয়সের শিশুরা কথা বলতে পারে না, এমনকি পালানোরও কোনো চেষ্টা করে না।
শিশু অপহরণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে টাঙ্গাইল মির্জাপুর থানার পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আবদুল মতিন এসব কথা জানায়। গত ১৮ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামিল হাসানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম অভিযান চালিয়ে মুক্তিপণের এক লাখ টাকাসহ টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা থেকে আবদুল মতিনকে গ্রেপ্তার করে। মতিনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, একই উপজেলার মসিন্দা এলাকার আরেকটি ভাড়া বাড়ি থেকে অপহৃত শিশুকে উদ্ধার করা হয়। ওই বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আবদুল মতিনের স্ত্রী মরিয়ম বেগমকে (৪৬)।
পুলিশ জানায়, আবদুল মতিনের বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চক্কপ দাসপাড়া গ্রামে। পারিবারিক অবস্থা ভালো নয়, আর্থিক অনটনের মধ্যে দিন কাটে। কখনো দিনমজুরি, কখনো ফেরি করে নিজের সংসার চালাত। কিন্তু ধনী হওয়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল তার। শহরে জায়গা কিনতে হবে_বাড়ি করতে হবে। আর কিভাবে ধনী হওয়া যায়? ধনী হওয়ার নেশায় পেয়ে বসে মতিনকে। কোনো উপায় না দেখে মাথায় আসে শিশু অপহরণের কথা। কম পরিশ্রম করে বেশি টাকা পাওয়ার উপায়। যেমন চিন্তা তেমন কাজ। আর দেরি না করে শুরু করে শিশু অপহরণ।
প্রথম ১৯৯১ সালে রংপুর শহরের দেড় বছরের একটি শিশুকে অপহরণ করে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে আবদুল মতিন। চিঠির মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকার জন্য ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করত। সফল হতে পারেনি সে। গ্রেপ্তার হয় পুলিশের হাতে। ছয় বছরের কারাদণ্ড হয়। ১৯৯৬ সালে মুক্তি পায়। কারাভোগ করার পরও সে ধনী হওয়ার ইচ্ছা ছাড়েনি। গত ৪ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের গোড়াই থেকে আবার ১১ মাসের এক শিশু অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করে পাঁচ লাখ টাকা। এবারও সফল হতে পারেনি আবদুল মতিন। ১৪ দিন পর গ্রেপ্তার হয় পুলিশের হাতে।
যেভাবে অপহরণ করা হয় : গত বছরের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি মির্জাপুর উপজেলার গোড়াইয়ে আবদুল লতিফের বাড়িতে এসে একটি রুম ভাড়া নেয়। নিজেকে পরিচয় দেয় ক্ষুদ্র কাপড় ব্যবসায়ী হিসেবে। নাম জানায় মফিজ। মির্জাপুরে কোথাও একটি দোকান ভাড়া নেওয়ার জন্য খুঁজছে। স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে থাকে। নিয়মিত নামাজ পড়ে, শব্দ করে কোরআন তেলাওয়াত করে। নামাজ পড়তে বলে ওই বাড়ির লোকদের। সকালে কাপড়ের গাঁট (ব্যাগ) নিয়ে বেরিয়ে যায়। আবদুল লতিফের ছোট নাতি নয়ন। বয়স ১১ মাস। তাকে দাদুমণি বলে ডাকত আবদুল মতিন (মফিজ)। মাঝেমধ্যে চকোলেট এনে দিত_ভীষণ আদর করত। কয়েক দিনের মধ্যে বাড়ির সবার কাছে বিশ্বস্ত ও আপন হয়ে ওঠে সে।
গত ৪ জানুয়ারি সকালে নয়নকে কোলে নিয়ে বাড়ির বাইরে বের হয়। তার দুদিন আগে মতিনের স্ত্রী সেখান থেকে চলে যায়। সকাল ১০টার দিকে নয়নের দাদা আবদুল লতিফের কাছে ফোন করে মতিন বলে, 'নয়নকে নিয়ে আইছি। ওরে পাইতে হলে দশ লাখ টাকা লাগব। আমি কাপড়ের ব্যবসা করি না। নয়নরে নেবার জন্যই আইছিলাম।' এ কথা শুনে আবদুল লতিফের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। অস্থির হয়ে ওঠেন বাড়ির সবাই। ছুটে যান মির্জাপুর থানা পুলিশের কাছে।
যেভাবে গ্রেপ্তার হয় : মির্জাপুর থানার ওসি হাবিবুল্লাহ সরকার এ খবর শোনার পরপরই টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামিল হাসানকে জানান। আবদুল মতিন (মফিজ) নয়নের দাদা ও বাবাকে মোবাইল ফোনে বারবার টাকার তাগিদ দিতে থাকে। নয়নের আত্মীয় সেজে ওসি হাবিবুল্লাহ সরকার মতিনের সঙ্গে ফোনে বিভিন্ন সময় কথা বলেন। তিনি মতিনকে জানান, তারা গরিব মানুষ, এত টাকা কিভাবে দেবেন? পরে মতিন টাকার পরিমাণ কমিয়ে পাঁচ লাখ বলে। এদিকে পুলিশ মতিনের খোঁজ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। টাঙ্গাইলের মধুপুরের দীঘরবাড়িতে মতিনের সন্ধান মিলতে পারে খবর পেয়ে পুলিশ, ডিবি, র্যাব দীঘরবাড়িতে টানা তিন রাত অভিযান চালিয়েও তার সন্ধান পায়নি। হঠাৎ জানতে পারে এলেঙ্গার কোথাও থেকে মতিন ফোনে কথা বলছে। তখন পুলিশ এলেঙ্গাকে টার্গেট করে জাল ফেলে।
অন্যদিকে ফোনে সব সময় মতিনের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে তাদের সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত এক লাখ টাকার বিনিময়ে শিশুকে ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় মতিন। তবে শর্ত দেয়, তার কথামতো ট্রেনে করে ঈশ্বরদী যাওয়ার পথে কোথাও টাকাটা ট্রেনের ডান পাশের জানালা দিয়ে ফেলতে হবে। ১৭ জানুয়ারি রাতে ওসি হাবিবুল্লাহ সরকার কয়েকজনকে নিয়ে ট্রেনে ওঠেন। এলেঙ্গার দক্ষিণে পৌলির কাছাকাছি আসার পর মতিন ফোন করে টাকাটা জানালা দিয়ে নিচে ফেলতে বলে। ওসি হাবিবুল্লাহ সরকার কৌশল করে কথা বলে চার-পাঁচ মিনিট সময় দেরিতে টাকা ফেলেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামিল হাসানের নেতৃত্বে পৌলির আশপাশের সব সড়কের মোড় ঘিরে ফেলা হয়। সারা রাত তারা একইভাবে সেখানে অবস্থান করে। ভোর ৬টার দিকে এক ব্যক্তিকে একটি ব্যাগ নিয়ে আসতে দেখে পুলিশের সঙ্গে থাকা নয়নের বাবা তাকে চিনতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে তাকে এক লাখ টাকাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পরে পাশের মসিন্দা গ্রামের একটি বাড়ি থেকে শিশু নয়নকে উদ্ধার এবং তার স্ত্রী মরিয়ম বেগমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অপহরণের আগের দিন ওই বাড়ির একটি ঘর সে ভাড়া নেয়। নয়নকে তাদের নাতি বলে পরিচয় দেয়। গ্রেপ্তারের আগে সারা রাত সে ধানক্ষেতে বসে ছিল বলে পুলিশকে জানায়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামিল হাসানের বক্তব্য : আবদুল মতিন অর্থাৎ মফিজকে গ্রেপ্তার করতে নানা কারণে খুব বেগ পেতে হয়েছে। এখানে সে সফল হলে হয়তো মসিন্দার ওই বাড়ির কোনো শিশু তার পরবর্তী টার্গেট হতো। কারো সম্পর্কে না জেনেশুনে বাড়ি ভাড়া দেওয়া একেবারে ঠিক নয়। কাগজে ভাড়াটিয়াদের হাতে লেখা ঠিকানা এবং এক কপি ছবি রেখে বাড়ি ভাড়া দেওয়া উচিত।
গ্রেপ্তারের পর পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষে আবদুল মতিন (মফিজ) ও তার স্ত্রী মরিয়ম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তারা এখন জেলহাজতে রয়েছে বলে জানান তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর আবু ওবায়দা খান।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন